শারীরিক অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা চরম দারিদ্র্য—এরকম বিপদে পড়লে অনেক সময় চিকিৎসার জন্য বা বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। নিজের জমানো টাকা বা ধার-দেনা করেও যখন কুলিয়ে ওঠা যায় না, তখন বিদেশি কোনো সাহায্য বা অনুদানই হতে পারে শেষ ভরসা।
বিদেশের অনেক ভালো মনের মানুষ ও সংস্থা আছে যারা আমাদের দেশের অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে চায়। কিন্তু সঠিক পথ না জানার কারণে আমরা অনেকেই সেই সাহায্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। আপনার বা আপনার পরিচিত কোনো অভাবী মানুষের যদি চিকিৎসার জন্য বা অন্য কোনো মানবিক কারণে বিদেশি অনুদানের প্রয়োজন হয়, তাহলে কীভাবে আবেদন করবেন জানতে পারবেন এখানে।
এই পোস্টে আমরা বিদেশি অনুদান কিভাবে পাবো তা ধাপে ধাপে আলোচনা করব। শুরু থেকে শেষ অব্দি পড়লে আপনি নিজেই অনলাইনের মাধ্যমে বিদেশি সাহায্যের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
বিদেশি অনুদান ক

বিদেশি অনুদান বা সাহায্য হলো, যখন অন্য কোনো দেশের কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্য পাঠায়। এই টাকা সাধারণত কোনো লোন নয়, অর্থাৎ এটি আপনাকে ফেরত দিতে হবে না। এটি পুরোপুরি একটি সাহায্য। এই সাহায্য দুই ধরনের হতে পারে। ব্যক্তিগত সাহায্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান।
ব্যক্তিগত সাহায্য
যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য, পড়ালেখার খরচের জন্য বা কোনো মানবিক কারণে সাধারণ মানুষ সবাই মিলে অল্প অল্প করে সাহায্য করে। এটা অনেকটা অনলাইনের ‘সাহায্যের বাক্স’-এর মতো, যেখানে যে কেউ তার ইচ্ছেমতো টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। একেই ব্যক্তিগত সাহায্য বলা হয়। এটাকে ভিন্ন ভাষায় ক্রাউডফান্ডিংও বলা হয়ে থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান
যখন কোনো বড় সংস্থা বা ফাউন্ডেশন একটি নির্দিষ্ট প্রজেক্ট বা কাজের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে যেমন: এনজিও, স্কুল, হাসপাতাল বড় অঙ্কের টাকা দেয় তখন সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান বলা হয়। বিভিন্ন দেশের বড় বড় চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান এভাবে অনেক দেশে বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য অনুদান দিয়ে থাকে। এসব অনুদানের টাকা দিয়ে মানবিক কাজ করা হয়।
ব্যক্তিগত সাহায্য কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি অনুদান অনেক কার্যকরী। কিভাবে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বা এনজিও প্রতিষ্ঠানের জন্য বিদেশি অনুদান পাওয়া যায় এ বিষয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বিদেশি অনুদান কিভাবে পাবো

এখন ঘরে বসেই বিভিন্ন দেশের বড় বড় চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান পাওয়ার জন্য আবেদন করা যায়। তবে, বিদেশি অনুদান পাওয়ার জন্য আবেদন করার পূর্বে অবশ্যই কিছু বিষয় জানতে হবে। এগুলো নিচে আলোচনা করা হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশ থেকে অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাহায্যের আবেদন করায় কিছু কিছু আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে আমাদের দেশের আবেদনকারীদের উপর বিশ্বাস কমে গেছে। তাই আপনার আবেদন যদি ১০০% সৎ এবং স্বচ্ছ না হয়, তবে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
ফোর্ড ফাউন্ডেশন বা USAID-এর মতো বড় সংস্থাগুলো সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে সরাসরি টাকা দেয় না। তারা বড় প্রজেক্টের জন্য রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান বা এনজিও-কে অনুদান দেয়। ব্যক্তিগত সাহায্যের জন্য আপনাকে যেতে হবে ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্মে।
বিদেশি অনুদান আবেদনের নিয়ম
ধরুন, আপনার কোনো আত্মীয়ের চিকিৎসার জন্য ৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এই টাকা তোলার জন্য আপনি একটি অনলাইন ক্যাম্পেইন করতে চান। চলুন, পুরো প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে দেখি।
ধাপ ১: প্রমাণপত্র প্রস্তুত করুন
আবেদন করার আগে আপনাকে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষ আপনাকে না চিনে, না জেনেই টাকা দেবে না। তাই আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনার আসলেই সাহায্য প্রয়োজন। এজন্য ডাক্তারের সব কাগজপত্র জোগাড় করুন। যার জন্য সাহায্য চাইছেন, তার অসুস্থতার সব মেডিকেল রিপোর্ট, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, চিকিৎসার খরচের হিসাব—এই সবকিছুর ছবি তুলে বা স্ক্যান করে ফাইল তৈরি করুন।
কেন আপনার টাকার প্রয়োজন, যার জন্য চাইছেন তার অবস্থা কতটা গুরুতর, এই টাকা তার জীবন কীভাবে বদলে দিতে পারে—এই বিষয়গুলো গুছিয়ে একটি গল্প লিখুন। গল্পটি অবশ্যই সত্য হতে হবে। কোনো কিছু বাড়িয়ে বলার দরকার নেই। রোগীর বর্তমান অবস্থার কিছু ছবি (অবশ্যই তার অনুমতি নিয়ে) এবং তার বা পরিবারের সদস্যদের একটি ছোট ভিডিও তৈরি করুন।
ধাপ ২: সঠিক প্ল্যাটফর্ম সিলেক্ট করুন
ব্যক্তিগত সাহায্যের জন্য আবেদন করার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ক্রাউডফান্ডিং ওয়েবসাইট। এখানে আপনি আপনার ক্যাম্পেইনটি পোস্ট করতে পারবেন এবং সারা বিশ্বের মানুষ তা দেখতে পাবে। কয়েকটি জনপ্রিয় ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম নিম্নরূপ –
- GoFundMe: এটি ব্যক্তিগত ও মেডিকেল সাহায্যের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি।
- Air Funding: এই ওয়েবসাইটটিও চিকিৎসা এবং মানবিক সাহায্যের জন্য বাংলাদেশে বেশ পরিচিত ও সফল।
- GlobalGiving: এটি মূলত বিভিন্ন সামাজিক প্রজেক্ট ও এনজিও-এর জন্য হলেও, কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ক্যাম্পেইনও সাপোর্ট করে।
ধাপ ৩: একটি আকর্ষণীয় ক্যাম্পেইন পেজ তৈরি করুন
ওয়েবসাইট বেছে নেওয়ার পর আপনাকে সেখানে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে ক্যাম্পেইন পেজ বানাতে হবে। এরপর, অনুদান পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। নিচে বিস্তারিত পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে।
ক্যাম্পেইন রান করার জন্য যে প্লাটফর্ম সিলেক্ট করেছেন, সেটির ওয়েবসাইটে ঢুকে আপনার ই-মেইল, নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং ফোন নম্বর দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট রেজিস্টার করুন।
“Start a Campaign” বা “Create a Fundraiser” অপশনে ক্লিক করুন। এরপর, আপনার ক্যাম্পেইনের একটি পরিষ্কার এবং আকর্ষণীয় শিরোনাম দিন। যেমন: “ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাই”। আগে থেকে লিখে রাখা গল্পটি এখানে পেস্ট করুন।
ডাক্তারের রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন ও অন্যান্য কাগজের ছবি বা পিডিএফ ফাইল আপলোড করার অপশন পাবেন। অবশ্যই এগুলো আপলোড করুন। আপনার মোট কত টাকা প্রয়োজন, সেই পরিমাণটি উল্লেখ করুন। রোগীর ছবি ও ভিডিও আপলোড করে আপনার ক্যাম্পেইনটি রান করুন।
ধাপ ৪: ক্যাম্পেইন শেয়ার করুন
ক্যাম্পেইন তৈরি করলেই কাজ শেষ নয়, বরং আসল কাজ এখান থেকেই শুরু। আপনাকে আপনার এই ক্যাম্পেইনের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আপনার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার—সব জায়গায় ক্যাম্পেইনের লিংকটি শেয়ার করুন এবং আপনার বন্ধুদেরকেও শেয়ার করতে অনুরোধ করুন।
বিদেশে যদি আপনার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় থাকে, তাদের মাধ্যমে ক্যাম্পেইনটি প্রচার করলে বিদেশি সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ক্যাম্পেইনে কত টাকা উঠল, রোগীর বর্তমান অবস্থা কী—এই বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত আপনার ক্যাম্পেইন পেজে আপডেট দিন। এতে ডোনারদের বিশ্বাস বাড়বে।
ধাপ ৫: টাকা গ্রহণ করা
আপনার ক্যাম্পেইনে যখন টাকা আসা শুরু করবে, তখন সেই টাকা আপনার কাছে কীভাবে পৌঁছাবে? ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণত লোকাল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। রেজিস্ট্রেশন করার সময়ই আপনাকে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য (নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর, ব্যাংকের নাম, সুইফট কোড) দিতে হবে। প্ল্যাটফর্মের ফি কেটে বাকি টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাবে।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করে যেকোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ক্যাম্পেইন রান করে বিদেশি অনুদান সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে, এসব ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম ছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে বড় বড় গ্রুপে ক্রাউডফান্ডিং পোস্ট করেও দেশ এবং বিদেশের মানুষের থেকে অনুদান নেয়া যাচ্ছে।
ফেসবুকে বিভিন্ন বড় বড় মানবিক গ্রুপ রয়েছে যেগুলো অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করে। এসব গ্রুপে আপনার বিপদের সময় পোস্ট করে, সঠিক তথ্য প্রদান করে অনুদান সংগ্রহ করার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এভাবে অনেকেই তাদের প্রয়োজনে অনুদান সংগ্রহ করছে।
সংস্থা বা এনজিওর জন্য অনুদান সংগ্রহ
যদি আপনি কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন: স্কুল, এতিমখানা বা সামাজিক সংগঠন এর জন্য ফান্ড সংগ্রহ করতে চান, তবে প্রক্রিয়াটি একটু ভিন্ন। আপনাকে বড় বড় দাতা সংস্থা খুঁজতে হবে। যেমন: USAID, The Leakey Foundation, Ford Foundation ইত্যাদি।
এরপর, প্রজেক্ট প্রপোজাল তৈরি করতে হবে। আপনার প্রতিষ্ঠান কী কাজ করে, এই ফান্ড দিয়ে কী করতে চান, কত টাকা লাগবে, কীভাবে খরচ করবেন—এই সবকিছুর বিস্তারিত লিখিত বর্ণনা দিয়ে একটি প্রফেশনাল প্রপোজাল বানাতে হবে।
আপনার সংস্থার সরকারি লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট, বিগত কয়েক বছরের অডিট রিপোর্ট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদি সবকিছু প্রস্তুত রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি ফরমাল এবং সময়সাপেক্ষ। এভাবে বিদেশি বিভিন্ন বড় ফাউন্ডেশন থেকে অনুদান সংগ্রহ করতে পারবেন।
আরো পড়ুন:
- ছাত্র জীবনে টাকা আয় করার উপায়
- কম খরচে ইউরোপের কোন দেশে যাওয়া যায়
- ড্রপশিপিং কি? ড্রপশিপিং ব্যবসা থেকে আয় করে কিভাবে
বিদেশি অনুদান সম্পর্কে আমাদের মতামত
বিপদে পড়লে বিদেশি অনুদান বা সাহায্য পাওয়া এখন আর অসম্ভব কিছু নয়। তবে এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সততা, স্বচ্ছতা এবং ধৈর্য। আপনার প্রয়োজন যদি সত্যিকারের হয় এবং আপনি যদি সঠিকভাবে মানুষের কাছে আপনার গল্পটা তুলে ধরতে পারেন, তাহলে দেশ-বিদেশ থেকে সাহায্য আসবেই।
মনে রাখবেন, কোনো ভুল তথ্য বা মিথ্যা গল্প দিয়ে সাময়িকভাবে কিছু টাকা হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এবং ভবিষ্যতে আপনার মতো সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়। তাই সব সময় সৎ থাকুন এবং সঠিক পথে চেষ্টা চালিয়ে যান। আপনার পরিচিত কারো প্রয়োজনে বিদেশি অনুদান প্রয়োজন হলে তাদের সাথে এই পোস্টটি শেয়ার করতে পারেন।