কেন্দ্রীকরণ বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি সংস্থার কার্যক্রম এবং সেই সংস্থার যাবতীয় পরিকল্পনা, যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিকল্পনা, কৌশল এবং নীতি প্রণয়ন সম্পর্কিত বিস্তারিত যা প্রতিনিয়ত ওই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। কেন্দ্রীকরণ সর্বোপরি একটা ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করতে পারে যেখানে ওই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সর্বস্তরের শ্রেণীবিন্যাস নির্ভর করে এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর উপর উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, কেন্দ্রীকরণ বলতে একটি নির্দিষ্ট কাজ বা ক্ষমতাকে বোঝায় যা সরাসরি ভাবে কোন গোষ্ঠীর বা ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত একই কেন্দ্র থেকে গ্রহণ করা হয় এবং সব কাজ একই জায়গা থেকে পরিচালিত হতে থাকে। আজকের পোস্টে আমরা কেন্দ্রীকরণ কি? কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন্দ্রীকরণ কি

কেন্দ্রীকরণ বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট কাজ বা ক্ষমতাকে এক কেন্দ্রীভূত করে এবং একই স্থানে বা ব্যক্তির হাতে নিবদ্ধ করে রাখে। এই পদ্ধতিতে সব ক্ষমতা কেবল মালিকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং সরকারি কেন্দ্রিকরনের ক্ষেত্রে একটি দেশের সকল ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। কেন্দ্রীকরণের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব, দায়িত্ব নির্ধারণ করা সহজ হয়, সমন্বয় করা সহজ হয়।
তবে কেন্দ্রিকরণের সুবিধা থাকার পাশাপাশি কিছু কিছু অসুবিধা রয়েছে। সেগুলো হলো:
- সর্বদা স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়,
- কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে নমনীয়তা অত্যন্ত কম,
- কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে কর্মচারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
বিকেন্দ্রীকরণ কি

সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন স্তরে যেমন আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকারকে ভাগ করে দেওয়া বুঝায়। বিকেন্দ্রীকরণের প্রধান সুবিধা হল: স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকে, যা বিকেন্দ্রিকরণ এর মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে সমাধান করা সম্ভব এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য অর্থাৎ স্থানীয় জনগণ নিজেদের বিষয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে।
স্থানীয় সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। কারণ স্থানীয় সমস্যাগুলো খুব দ্রুত স্থানীয়ভাবে বোঝা সম্ভব এবং স্থানীয়ভাবেই সমাধান করতে হয়, যা কোনভাবে বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া সম্ভব নয়। বিকেন্দ্রীকরণ এর আরেকটি মূল উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা। জনগণের অংশগ্রহণ যখন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ চালু রয়েছে।
কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এর মধ্যে পার্থক্যসমূহ
কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রিকরণ এর পার্থক্যসমূহ জানার পূর্বে আগে জেনে নিতে হবে কেন্দ্রীকরণ এবং বি কেন্দ্রিকরণের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি।
কেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ
- কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত একজন ব্যক্তি বা একটি ছোট দলের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব।
- কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সংগঠনের সব কাজ কঠোর নিয়মকানুন মেনে পরিচালনা করা সম্ভব।
- কেন্দ্রীয় করনের ক্ষেত্রে নিচের স্তরের কর্মচারীদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা বেশ কম থাকে।
- কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
- কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সমগ্র সংগঠনে একই ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে।
বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্য
ইতোমধ্যে আমরা কেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। চলুন এক নজরে বিজ্ঞানী করনের বৈশিষ্ট্য গুলো দেখে আসা যাক:
- কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের একচেটিয়া ক্ষমতা কমাতে এবং ক্ষমতা বিভিন্ন স্তরে বন্টন করে দেওয়ার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।
- বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ এবং সংস্থাগুলো আরো বেশি ক্ষমতা পেয়ে থাকে।
- বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য স্থানীয় ইউনিটগুলোকে দায়ী করা হয়ে থাকে।
- বিকেন্দ্রীকরণ এর মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্ভব।
- বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
- সম্পদ এবং সংস্থার স্থানীয় পর্যায়ে আরো ভালোভাবে বন্টন করা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণ এর মাধ্যমে
চলুন এক নজরে একটি ছকের মাধ্যমে কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ এর মধ্যে পার্থক্য দেখে আসা যাক:
বৈশিষ্ট্য | কেন্দ্রীকরণ | বিকেন্দ্রিকরণ |
ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ | কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীয় স্তরে কেন্দ্রীভূত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। | বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার নির্দিষ্ট একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন স্তরে বন্টিত হতে থাকে। |
সিদ্ধান্ত গ্রহণ | কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সকল ধরনের ছোট এবং বড় সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় স্তর থেকে গৃহীত হয়ে থাকে। | বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা উচ্চস্তর থেকে গ্রহণ করা হয় না বরং নিম্ন স্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয়। |
নিয়ন্ত্রণ | কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সকল কিছু কেন্দ্রীয় স্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে, এবং এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অন্য কারো হাতে বন্টন করা হয় না। | বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সকল ধরনের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ভার নিম্নস্তরে প্রদান করা হয়ে থাকে। নিম্ন স্তর থেকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে সকল ধরনের সমস্যার সমাধান করে থাক নাগিনে। |
সরকারি কাঠামো | একক ও কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। | বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে অঞ্চলীয় সরকারের সমন্বয় সাধন হয়ে থাকে। |
সুবিধা | কার্যকরী সমন্বয় এবং দ্রুত সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রিকরণ অত্যন্ত জরুরি। | অপরদিকে, স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি। |
অসুবিধা | কেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রয়োজন উপেক্ষা করা হয়ে থাকে যার ফলশ্রুতিতে নীতি বাস্তবায়নে কিছুটা দেরি হয়। | অপরদিকে, বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং সমন্বয়ের জটিলতা দেখা দেয়। |
কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ উভয়ের মধ্যেই নিজস্ব কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। কেন্দ্রিকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে কোন পদ্ধতিটি ভালো হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে স্থানের উপর, ভৌগলিক অবস্থানের উপর, জনসংখ্যার উপর, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর। কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ যেহেতু একটি মিশ্র পদ্ধতি সেহেতু এর সুষম মিশ্রণ তাই এর মিশ্রণ এই সব থেকে ভালো ফলাফল প্রদান করে। কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণের উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো:
কেন্দ্রীকরণের উদাহরণ হল উত্তর কোরিয়ার এমন একটি দেশ যেখানে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। অপরদিকে বিকেন্দ্রীকরণের উদাহরণ হল: ভারত এমন একটি দেশ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা বন্টন করা হয়ে থাকে।
কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর
কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ নীতি কি?
কেন্দ্রীকরণ নীতি হলো সব ক্ষমতা এক জায়গায় বা একই ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করে রাখা। অপরদিকে বিকেন্দ্রীকরণের নীতি হলো যেকোনো একটি ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরে বা বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ক্ষমতাকে বন্টন করে দেওয়া।
কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণকে প্রভাবিত করে কোনটি
কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ কে প্রভাবিত করতে পারে প্রতিষ্ঠানের কৌশল, আকার, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, কর্মচারীর সম্পৃক্ততা। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক পরিবেশ, কাজের ধরন এবং প্রকৃতি ইত্যাদি কেন্দ্রিকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ কে প্রভাবিত করতে পারে।
কেন্দ্রীভূত ও বিকেন্দ্রীকৃত ক্রয় কাকে বলে?
কেন্দ্রীভূত ক্রয় বলতে বোঝায় কেন্দ্রীয় স্থান থেকে সবকিছু ক্রয় করা। অপরদিকে বিকেন্দ্রীভূত ক্রয় বলতে বোঝায় কোন সংস্থার বিভিন্ন বিভাগ বা অন্যান্য শাখা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করা।
কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আমাদের মতামত
কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ শব্দ দুইটি সবচেয়ে বেশি উঠে আসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। কেন্দ্রীকরণ ভালো নাকি বিকেন্দ্রীকরণ ভালো, এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে পরিবেশ এবং পরিস্থিতির উপর। আজকের পোস্টে আমরা কেন্দ্রিকরণ কি? কেন্দ্রীকরণ এবং বি কেন্দ্রিকরণ এর পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন এবং এরকম তথ্যসমৃদ্ধ আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন